ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন শেষে মানববন্ধনেও হামলা রাজবাড়ীর এমপির ভয়ংকর দুঃশাসনে জিম্মি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা!

স্টাফ রিপোর্টার।।

রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিমের বিরুদ্ধে ক্যাডার পুষে দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠেছে। তাদের ইশারায় বহু নেতাকর্মী নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। আজ বুধবার (১৪ অক্টোবর) দুপুর ১২টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্র্যাব) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন রাজবাড়ীর আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

এদিকে, সংবাদ সম্মেলন শেষে মানববন্ধন করতে গেলে উপস্থিত পুলিশের সামনেই নির্যাতিত নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায়ও সাংসদ জিল্লুল হাকিমের দিকে আঙুল উঠেছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, হামলাকারীরা জিল্লুল হাকিমের নির্দেশে মানববন্ধন ভণ্ডুল করতে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। এর আগে সংবাদ সম্মেলনও ভণ্ডুল করতে পাঁয়তারা করেছিলেন ওই সাংসদ।

ক্র্যাব কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী, নির্যাতিত ও হত্যাকাণ্ডের শিকার নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবারের পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন রাজবাড়ী জেলা কৃষক লীগ নেতা মোস্তফা মাহমুদ হেনা মুন্সী। এ সময় রাজবাড়ী-২ আসনের আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নির্যাতিত নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ডের শিকার নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীরা জানান, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত অন্যায় ও প্রতিহিংসাবশত খুন, হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। এমপি ও তার ছেলের পোষা ক্যাডার বাহিনীর হামলায় অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে পড়েছেন। নির্যাতনে টিকতে না পেরে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।

এমপি ও তার ছেলে এবং তাদের ক্যাডার বাহিনীকে কোনভাবে দমিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে ভুক্তভোগীরা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা বলেন, আওয়ামী লীগের দুর্দিনে কাজ করলেও গত ১২ বছর ধরে তারা জিম্মি অবস্থায়। এমপি জিল্লুল হাকিম ও তার পুত্রের দুঃশাসন থেকে তারা মুক্তি চান। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জেল-জুলুমসহ অকথ্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। দল ক্ষমতায় আসার পরও এভাবে নিজ দলীয় এমপির প্রতিহিংসাপরায়নতার কারণে আমরা চরম খুন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তারা এসব খুন ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক দোষীদের বিচার দাবি করেন। পাশাপাশি এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের শামিল হতে চান।

লিখিত বক্তব্যে মোস্তফা মাহমুদ হেনা মুন্সী জানান, একটানা তিন মেয়াদে জিল্লুল হাকিম সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েও দলে ভিড়িয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী ও রাজাকারের সন্তানদের। যাদের হাতে ২০০১ সালের পর আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের ত্যাগী নেতাকর্মীরা হামলা-মামলার শিকার হয়ে এলাকাছাড়া হয়েছেন। এসব হাইব্রিড নেতারা জিল্লুল হাকিমের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আওয়ামী নেতাকর্মী নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছে। বিগত এক যুগে আওয়ামী লীগের প্রায় ৩৯ জন নেতাকর্মী খুন এবং হামলার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন শতাধিক নেতাকর্মী।

তিনি বলেন, রাজবাড়ীতে সত্য বলা মানা। সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে জাতীয় দৈনিক ‘স্বদেশ প্রতিদিন’-এর জেলা প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ এমপিপুত্রের হাতুড়ি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে পঙ্গু জীবনযাপন করেছেন। এই বাহিনীর নির্যাতনে অনেক নেতাকর্মী পঙ্গু হয়ে গেছেন। এলাকাছাড়া হয়েছেন দুই শতাধিক। এমনকি সংখ্যালঘু পরিবারের অনেক জমি দখলও করেছেন তারা।

ভিটা-মাটিসহ জমি দখলের কারণে কালুখালির মদাপুর ইউপি সদস্য বিউটি প্রামানিক, সুভাষ প্রামানিক, মদন প্রামানিক, অনিল বিশ্বাস, নমিতা রানি, বাদল চক্রবর্তীসহ দেড় শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবার এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন।এসব বিষয়ে কেউ ভয়ে অভিযোগ করতে সাহস পান না। দু-একজন অভিযোগ করলেও প্রশাসনের অসহযোগিতা এবং তাদের হুমকির মুখে টিকে থাকতে পারেননি।

সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তথ্য মতে, গত ১৩ মার্চ সকালে আহত বড় ভাইকে দেখে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে পাংশা উপজেলার সুবর্ণখোলা গ্রামের মৃত খোরশেদ আলী খানের ছেলে স্কুলশিক্ষক আসাদুল খানকে গুলি করে হত্যা করেন এমপির ঘনিষ্ঠ ও জেলার শীর্ষ সন্ত্রাসী জজ আলী বিশ্বাসের নির্দেশে। এ ঘটনার জড়িত থাকার অভিযোগ আসামিদের গ্রেপ্তার করলে খুনিদের পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নামেন এমপি জিল্লুল হাকিম ও তার পুত্র মিতুল হাকিম। খুনিদের গ্রেপ্তার করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানকে বদলি করতে দলীয় প্যাডে ডিও লেটার দেন সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম। জিল্লুল হাকিমের পোষা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ সুপারকে বদলি করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।

এ সময় নিহত স্কুলশিক্ষক আসাদুল খানের স্ত্রী রত্না খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, কি দোষ ছিল আসাদুলের। তিনি তো আওয়ামী লীগের রাজনীতিই করেছেন। দল ক্ষমতায় থাকার পরও এভাবে যদি খুন হতে হয়, তাহলে আমরা যাব কোথায়। খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে। কেউ কিছু করছে না। কার কাছে বিচার দিব।

আরেক আহত নেতা জাফর জোয়ারদারের পিতা মুক্তিযোদ্ধা সাবেদ আলী জোয়ারদার জানান, দীর্ঘদিন ধরে এক এমপির কাছেআ রাজবাড়ী এলাকার সত্যিকারের নেতাকর্মীরা জিম্মি হয়ে আছেন। দলের জন্য সারাজীবন কাজ করার পরও দলীয় এমপির নির্দেশে খুন নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্যমতে, সর্বশেষ গত ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে খুনের শিকার হয়েছেন কালুখালী উপজেলার বেতবাড়িয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আছির উদ্দিনের ছেলে যুবলীগ নেতা রবিউল ইসলাম।

জিল্লুল হাকিমের ক্যাডার ইউসুফ মেম্বার ও তার দুই পুত্র মিলে প্রকাশ্যে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেন। ওই ঘটনায় খুনীদের গ্রেপ্তার করলে এমপি জিল্লুল হাকিম তাদের বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

মোস্তফা মাহমুদ হেনা মুন্সী জানান, গত বছরের ১৭ জুন কালুখালী উপজেলার মোহনপুর গ্রামের কেছমত শেখের ছেলে ভ্যানচালক আব্দুর রহিম খুন হন। যার খুনের পেছনে সরাসরি এমপিপুত্র মিতুল হাকিম জড়িত। এমপির ক্যাডার ইউসুফ মেম্বার ও আনোয়ার ডাক্তারের মাধ্যমে পরিকল্পনা করে ভ্যানচালককে খুন করানো হয়। তার অপরাধ ছিল ওই ভ্যানচালক উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সাইফুল ইসলামের পক্ষে কাজ করেছিলেন।

একইভাবে জিল্লুল হাকিম ও তাঁর ছেলের আশ্রিত ক্যাডারদের হামলায় খুন হন কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের কৃষক লীগের সহ-সভাপতি মো. আমজাদ, পাংশা উপজেলার উপজেলা যুবলীগের সদস্য আবু হাসান হাপু, একই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষক লীগের সভাপতি মুন্সি নাদের হোসেন, মৌরাট ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত হোসেন মেম্বার, কালুখালী উপজেলার সাওরাইল ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ মিয়াসহ অনেকে। এমপিপুত্র মিতুল হাকিমের হাতুড়ি বাহিনীর নির্যাতনে দুই পা হারান কালুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান।

সংবাদ সম্মেলনে রাজবাড়ী এলাকায় জিল্লুল হাকিমের ক্যাডার বাহিনি পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ক্যাডারদের নাম উল্লেখ করেন তিনি। তার তথ্য মতে, এই ক্যাডারদের মধ্যে অন্যতম কালুখালীর ইউসুফ মেম্বার, মিজানুর রহমান মজনু, শাফিন সরোয়ার তুষার, লাবু জোয়াদ্দার, জামিল মেম্বার, আতিউর রহমান নবাব, কামাল বিশ্বাস, সুমনসহ অর্ধশত। পাংশায় অন্যতম হলেন মনোয়ার হোসেন জনি। পাংশায় আরো আছে মো. শফিক, শাহেদ আলী, মো. আলী, নয়ন, ইফতেখার, নাজমুল হাকিম রুমী, মো. রিপন, মিলন, মারুফ সর্দার, খন্দকার ছিসিলসহ অর্ধশত ক্যাডার। বালিয়াকান্দি উপজেলায় সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত তাঁর চাচাতো ভাই এহসানুল হক সাধন। একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সাধন। প্রভাব খাটিয়ে তাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে বসিয়েছেন সংসদ সদস্য। এই সাধনের নেতৃত্বে উপজেলার সন্ত্রাস, মাদক কারবার, জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে। তাঁর সঙ্গে আছেন সাহেব আলী, শ্যাম্পু মোল্লা ও মামুন মোল্লা, মিলন মেম্বার, হিল্লোল বসু, মাধব ঘোষ, বাদশা, বাদশা আলমগীর, আবুল কালাম আজাদ, রিপন বিশ্বাস, রাসেল খান রিজু, ফারুক বেশ কয়েকজন।

তিনি আরও বলেন, এমপির বদান্যতায় আওয়ামী লীগ পরিণত হয়েছে হাইব্রিড ও সুবিধাবাদী নেতাকর্মীতে। এদের মধ্যে পাংশা উপজেলায় বহুল বিতর্কিত যুবদল নেতা মনোয়ার হোসেন জনি এখন এমপিপুত্র মিতুল হাকিমের প্রধান সেনাপতি হয়ে দল এবং এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিএনপি নেতা উত্তম কুন্ডু ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এবং জেলা পরিষদের সদস্য। বিএনপি নেতা আবুল কমিশনার ও তার ছেলে সন্ত্রাসী রাজ্জাক আওয়ামী লীগে ২০১৫ সালে যোগ দিয়ে সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট করে এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। বিএনপি নেতা উবায়দুর রহমান চুন্নু বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। বিএনপির ক্যাডার লাল্টু বিশ্বাস বর্তমান পৌর আওয়ামী লীগের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি। কালুখালি উপজেলা মো. ইউসুফ হোসেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলো উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ও উপজেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক। বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-প্রচার সম্পাদক ও মাঝবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। তিনি বহু মামলার আসামি। এলাকার কুখ্যাত রাজাকারপুত্র আলিউজ্জামান চৌধুরী টিটোকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ১ নম্বর সদস্য বানিয়েছেন এমপি জিল্লুল হাকিম। বালিয়াকান্দি উপজেলায় বারবার দলবদল করা বিএনপির নেতা এমপির চাচাতো ভাই এহসানুল হক সাধন বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বহরপুরের রেজাউল চেয়ারম্যান বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

Comments

comments

%d bloggers like this: