চৌদ্দগ্রামে ইউপি মেম্বারের সমন্বয়ে জাল-জালিয়াতি চক্র ‘হিন্দু সেজে’ নকল কাগজে অন্যের জায়গা বিক্রি, ভুমি কর্মকর্তাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

চৌদ্দগ্রাম প্রতিনিধি


নুরুল বাহার প্রকাশ বুলেট বাহার ওরফে সুভাষ দেবনাথ। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ৬নং ঘোলপাশা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের বর্তমান ইউপি মেম্বার। তিনি সালুকিয়া গ্রামের মৃত মকরম আলীর পুত্র। মাদক, অস্ত্রসহ একাধিক মামলার আসামি। ভুয়া চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, ভারতীয় নাগরিকদের নামে ভুয়া জন্মনিবন্ধন, ভুয়া ওয়ারিশ সনদপত্রসহ সকল কাগজপত্র তৈরির মূল হোতা। কালো চেহারা হওয়ায় মাঝে মধ্যে তিনি মুসলমান থেকে হিন্দু বনে যান। গড়ে তুলেছেন বিশাল জালিয়াতি চক্র। আর এ চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে ইউপি কার্যালয়, ভুমি অফিস ও সাব রেজিষ্টার অফিসের অসাধু কর্মকর্তারা। একাধিকবার র‌্যাব ও পুলিশের হাতে অস্ত্র ও মাদক নিয়ে গ্রেফতার হলেও কয়েকদিন পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও চালিয়ে যান অপরাধ কর্মকান্ড। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার তাঁর বাড়ি হওয়ার সুবাধে অনায়াসে মাদক পাচার ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
নুরুল বাহার প্রকাশ বুলেট বাহার ওরফে সুভাষ দেবনাথ এবার নিজেকে হিন্দু পরিচয় দিয়ে ভারতীয় নাগরিকদের ১৯ শতক জায়গা সাব-কবলামূলে দলিল সৃজন করে বিক্রি করে দিয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী হাজী মন্তাজ উদ্দিনের পুত্র শাহজাহান মজুমদার গত ৭ মার্চ কুমিল্লার বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ৫নং আমলী আদালতে গ্রহীতা আবুল কাশেম, দাতা নুরুল বাহার প্রকাশ বুলেট বাহার ওরফে সুভাষ দেবনাথ, স্বনাক্তকারী আবদুল কুদ্দুস, স্বাক্ষী আবু আহম্মদ ভুঁইয়া সোহাগ, আবুল হাসান ভুঁইয়া নয়ন, ঘোলপাশা ইউপি সচিব দেলোয়ার হোসেন মোল্লা, ঘোলপাশা ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান মুন্সিরহাট ইউনিয়নের তহশীলদার আবুল খায়ের ও দলিল লেখক বেতিয়ারার আবুল হাশেমসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুলিশ ইনভেশটিগেশন ব্যুরো(পিবিআই) তদন্ত করছে।
মামলার অভিযোগ ও দলিল পর্যালোচনা করে জানা যায়, মামলার বাদি শাহজাহান মজুমদারের দাদা মৃত তরব আলী গং ১৯৬৩ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পুরান রাজবাড়ি থানার রাঙ্গামুড়া গ্রামে বসবাস করতেন। আর ক্ষিরোধ চন্দ্র সন্যাসী গং বসবাস করতেন বাংলাদেশের ঘোলপাশা ইউনিয়নের আমানগন্ডা গ্রামে। ১৯৬৩ সালের ১৭ জুলাই তরব আলী গং ক্ষিরোধ চন্দ্র সন্যাসী গংয়ের সাথে এক্সচেঞ্জ দলিল বিনিময় করে তরব আলী গং বাংলাদেশে আছেন এবং ক্ষিরোধ চন্দ্র সন্যাসী গং ভারতে চলে যান এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকে তরব আলী গং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ক্ষিরোধ চন্দ্র সন্যাসী গংয়ের সাথে বিনিময় করা ১৯ শতক জায়গার উপরে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীতে ভুলবশত বিএস জরিপে ক্ষিরোধ চন্দ্র সন্যাসীর নামটি চলে আসায় তরব আলীর পুত্র মমতাজ উদ্দিন কুমিল্লা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানী মামলা করেন। মামলা নং-১১১/১৯, বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। আর এ সুযোগটি কাজে লাগান ইউপি মেম্বার সীমান্ত এলাকায় অপরাধ জগতের সম্রাট নুরুল বাহার ওরফে বুলেট বাহার ওরফে সুভাষ দেবনাথ। তিনি ক্ষিরোধ চন্দ্র সন্যাসীর পুত্র ভারতীয় নাগরিক অকিন্দ দেবনাথের নামে ঘোলপাশা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্ম সনদ দেখিয়ে গত বছরের ১৪ নভেম্বর ভুমি তহশীলদার আবুল খায়েরের যোগসাজশে একটি নামজারি(জমা খারিজ) করিয়ে নেন। আর এ জমা খারিজে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করা হয়। দেড় মাসের ব্যবধানে অকিন্দ দেবনাথের পুত্র ভারতীয় নাগরিক সুভাষ দেবনাথের নামে একই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওয়ারিশ সনদপত্র ও একটি জন্ম সনদ দিয়ে ভুমি কর্মকর্তার যোগসাজশে ২৬ ডিসেম্বর আরও একটি নামজারি(জমা খারিজ) করিয়ে নেন। এরপর নিজেকে সুভাষ দেবনাথ দাবি করে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি গুণবতী সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে গিয়ে নুরুল বাহার তাঁর বাড়ির পাশ^বর্তী মৃত আবদুল গফুরের পুত্র আবুল কাশেমের নিকট ওই ১৯ শতক জায়গা বিক্রি করে দেন। যার দলিল নং-৩৩২।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুভাষ দেবনাথে বাবা অকিন্দ দেবনাথ প্রায় ১৫ বছর আগে ভারতে মৃত্যুবরণ করেন। জন্ম সনদ পর্যালোচনা সুভাষ দেবনাথের বাবা অকিন্দ দেবনাথের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। আর সুভাষ দেবনাথে জন্ম ১৯৭২ সালের ২০ ডিসেম্বর। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় চতুর বুলেট বাহার থানায় চলতি মাসের ২ তারিখে চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি(জিডি) দায়ের করেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, কে বা কাহারা ৪ ফেব্রুয়ারি গুণবতী সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে ৩৩২ নং দলিলে তাকে সুভাষ দেবনাথ সাজিয়ে তাঁর ছবি দিয়ে দলিল একটি সম্পাদন করেন।
এদিকে নুরুল বাহার ওরফে বুলেট বাহার জমির বাদ খারিজে ব্যবহৃত ওয়ারিশ সনদে থাকা ৩ জনের নাম সুকৌশলে মুছে সেখানে নিজেকে সুভাষ পরিচয়ে জাল-জালিয়াতি ও ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজসে সপ্তাহ ব্যবধানে প্রথমে প্রায় ১৫ বছর আগে মারা যাওয়া অকিন্দ দেবনাথ ও পরে সুভাষ দেবনাথের নামে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি বাদ খারিজ করিয়ে নেন এবং আবুল কাশেম নামের এক ব্যাক্তির নিকট মূল্যবান এ জায়গাটি বিক্রি করে দেন।
এসব বিষয়ে জানতে মামলার ১নং আসামি দলিল গ্রহীতা আবুল কাশেমর কাছে গেলে সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে কৌশলে পালিয়ে যান। পরে তাকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
তবে সাধারণ মানুষ বলছেন টাকার লোভে ভূমি অফিসগুলোতে জাল-জালিয়াতি এখন প্রতিদিনের চিত্র। তদন্ত করে এ চক্রের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তাদের।
এ বিষয়ে গুণবতী সাব-রেজিষ্টার উপমা নাগ জানান, সুভাষ দেবনাথকে সনাক্ত করেই ৩৩২নং দলিল রেজিষ্ট্রি হয়েছে। তবে মূল রহস্যের বিষয়টি হলো-নিয়মতান্ত্রিকভাবে জমিদাতার ন্যাশনাল আইডি কার্ড সংযোগ করার নিয়ম থাকলেও সেখানে সুধুমাত্র জন্মসনদ জমা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উপমা নাগকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। অনুসন্ধানে চৌদ্দগ্রামের গুনবতী সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে গেলে সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে দলিল লেখক পালিয়ে যান। তবে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে না থাকায় মুঠোফোনে দলিল সম্পর্কে জানান তহসিলদার ও সহকারি কমিনারের রিপোর্ট দেখে শতভাগ নিয়ম মেনেই দলিল সম্পাদন করা হয়েছে বলে তারা দাবি করেন।
নুরুল বাহারের দায়েরকৃত জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই আরিফ হোসেন জানান, ‘জিডিটি তদন্ত করা হচ্ছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দায়ের করা হবে’।
ভারত থেকে ইমো নাম্বারে আসল সুভাষ দেবনাথ জানান, ১৯৬৩ সালের পরে আমরা কেউ বাংলাদেশে যাইনি। বর্তমানে আমরা ভারতের নাগরিক। আমরা মৃত তরব আলী গংয়ের সাথে এক্সচেঞ্জ করেই বর্তমানে ভারতে বসবাস করছি।
ভারতীয় নাগরিক হওয়া স্বত্তেও কিভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মসনদ ও ওয়ারিশ সনদ পায় এ বিষয়ে ঘোলপাশা ইউপি চেয়ারম্যান কাজী জাফরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অকিন্দ দেবনাথ ও সুভাষ দেবনাথ নামে আমি কোন ভারতীয় নাগরিকের নামে জন্ম সনদ প্রদান করি নাই। কে বা কাহারা আমার স্বাক্ষর ও সিল জালিয়াতি করে সনদগুলো তৈরি করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিব কর্তৃক স্বাক্ষরীত ভারতীয় নাগরীককে জন্ম নিবন্ধন দেয়া এবং মামলার বিষয়ে অনুসন্ধানে গোলপাশা ইউনিয়ন পরিষদে গেলে চেয়ারম্যান ও সচিব জানান স্বাক্ষরগুলো তাদের নয় এবং এ নামের কাউকে তারা চিনেন না। চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহম্মেদ জানান, ইউপি মেম্বার নুরুল বাহার আমানগন্ডা গ্রামের সনাতন পরিবারের ৩ জনের নাম উল্লেখ করে একটি ওয়ারিশ সনদ পাওয়ার আবেদন করেছিলেন তাতে সুভাষের নাম ছিলো না কিংবা তাতে তারিখও উল্লেখ নেই।
মামলায় অভিযুক্ত ঘোলপাশা ইউপি সচিব দেলোয়ার হোসেন মোল্লা জানান, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। ভারতীয় নাগরিকের কোন জন্ম সনদে স্বাক্ষর করি নাই’।
মামলায় অভিযুক্ত ঘোলপাশা ইউনিয়নের সাবেক ও মুন্সিরহাট ইউনিয়নের বর্তমান তহশীলদার আবুল খায়ের দাবি করেন, কাগজপত্র সঠিক থাকায় আমি অকিন্দ দেবনাথ ও সুভাষ দেবনাথ নামীয় দুই ব্যক্তির জমা খারিজ প্রদান করি।
অভিযুক্ত নুরুল বাহার জানান, ‘আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। এ বিষয়ে আমি চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি’।
চৌদ্দগ্রাম সহকারী কমিশনার (ভুমি) আল আমিন সরকার বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের তহশীলদাররা নামজারির প্রস্তাবনা দিলেই আমি তা অনুমোদন করিয়ে দেই। কেউ যদি অনৈতিক কর্মকান্ড ঘটায় তাহলে এর দায় সংশ্লিষ্ট তহশীলদারের’।

Comments

comments

%d bloggers like this: